সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

তাদের বিশ্বাস অনুকরণ করুন | যোষেফ

“আমি কি ঈশ্বরের প্রতিনিধি?”

“আমি কি ঈশ্বরের প্রতিনিধি?”

কল্পনা করুন, এক পড়ন্ত বিকেলে যোষেফ তার বাগানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি খেজুর গাছ এবং অন্যান্য ফলের গাছ ও সেইসঙ্গে দিঘিতে ভেসে থাকা উদ্ভিদ দেখছেন। আর প্রাচীরের ঠিক ওপারেই ফরৌণের প্রাসাদের একটু অংশ দেখা যাচ্ছে। যোষেফের বাড়ি থেকে মৃদু শব্দ ভেসে আসছে; যোষেফের বড়ো ছেলে মনঃশি এবং তার ছোটো ভাই ইফ্রয়িমের হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। তিনি বুঝতে পারছেন, তার স্ত্রী সন্তানদের দেখে হাসছেন। যোষেফও আনন্দে হাসেন। তিনি জানেন, ঈশ্বর তাকে প্রচুর আশীর্বাদ করেছেন।

যোষেফ তার বড়ো ছেলের নাম রেখেছিলেন মনঃশি কারণ এর অর্থ হল, বিস্মৃতি বা ভুলে যাওয়া। (আদিপুস্তক ৪১:৫১) তার বাড়ি এবং পরিবারের কথা মনে করে তিনি প্রায়ই অনেক দুঃখ পেতেন। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঈশ্বরের কাছ থেকে আশীর্বাদ পেয়ে তিনি সেই দুঃখ অনেকটা ভুলে গিয়েছেন। তার প্রতি ভাইদের ঘৃণা যোষেফের জীবন পালটে দিয়েছিল। তার ভাইয়েরা তাকে আক্রমণ করে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিলেন এবং পরে তাকে দাস হিসেবে বণিকদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এই ঘটনার পর থেকে, তার জীবনে একের পর এক উত্থান-পতন ঘটে। প্রায় বারো বছর ধরে তাকে বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থা সহ্য করতে হয়। প্রথমে, তাকে দাসত্ব এবং পরে বন্দিত্ব ভোগ করতে হয়। এমনকী বন্দিত্বে থাকাকালীন তাকে কিছু সময়ের জন্য লোহার বেড়িতেও আটকে রাখা হয়। কিন্তু, এখন তিনি মিশরের বলবান জাতির শাসক ফরৌণের পরেই দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন!

বিগত কয়েক বছর ধরে যোষেফ বিভিন্ন বিষয় ঘটতে দেখেন আর এগুলো একেবারে যিহোবার ভবিষ্যদ্‌বাণী অনুযায়ীই ঘটে। ভবিষ্যদ্‌বাণী অনুযায়ী সাত বছর মিশরে প্রচুর শস্য উৎপন্ন হয় আর যোষেফ সেই শস্য মজুত করার কাজ দেখাশোনা করেন। এরই মধ্যে তিনি আসনৎ নামে এক মেয়েকে বিয়ে করেন এবং দুই সন্তানের বাবা হন। তারপরও, প্রায়ই পরিবারের কথা, বিশেষ করে তার ছোটো ভাই বিন্যামীন এবং বাবা যাকোবের কথা তার মনে পড়ত, যারা শত শত কিলোমিটার দূরে বাস করত। তারা কেমন আছে, কীভাবে আছে, সেটা নিয়ে তিনি হয়তো চিন্তা করতেন। তিনি সম্ভবত ভাবতেন, তার ভাইদের হিংসাত্মক মনোভাব আদৌ পরিবর্তন হয়েছে কি না অথবা পরিবারের মধ্যে যে-ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে, তা তিনি জোড়া লাগাতে পারবেন কি না।

হিংসা, বিশ্বাসঘাতকতা অথবা ঘৃণার কারণে আপনার পরিবারের শান্তি যদি কখনো নষ্ট হয়ে থাকে, তা হলে আপনিও হয়তো যোষেফের মতো একই পরিস্থিতি ভোগ করেছেন। তার পরিবারের ভরণপোষণ জোগাতে গিয়ে তিনি যে-বিশ্বাস দেখিয়েছিলেন, তা আমরা কীভাবে অনুকরণ করতে পারি?

“তোমরা যোষেফের নিকটে যাও”

যোষেফের দিনগুলো ব্যস্ততায় কেটে যাচ্ছে আর বছরগুলো হু-হু করে উড়ে যাচ্ছে। ফরৌণের স্বপ্নের মাধ্যমে যিহোবা যেমন ভবিষ্যদ্‌বাণী করেছিলেন, প্রথম সাত বছর প্রচুর শস্য হওয়ার পর মারাত্মক পরিবর্তন দেখা দেয়। সেটা কী? পরের সাত বছর কোনো শস্যই হয় না! সমস্ত প্রতিবেশী দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। কিন্তু, বাইবেল যেমন বলে, “সমস্ত মিসর দেশে ভক্ষ্য ছিল।” (আদিপুস্তক ৪১:৫৪) কোনো সন্দেহ নেই, ঈশ্বরের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বলা যোষেফের ভবিষ্যদ্‌বাণীর ও সেইসঙ্গে উত্তম উপায়ে খাবার সংগঠিত করার কারণে মিশরীয়রা উপকার লাভ করেছিল।

যোষেফ নম্রতা বজায় রেখেছিলেন বলে যিহোবা তাকে তাঁর কাজে ব্যবহার করেছিলেন

মিশরীয়রা নিশ্চয়ই যোষেফের প্রতি কৃতজ্ঞ হয় এবং একজন উত্তম সংগঠক হিসেবে তার দক্ষতা দেখে প্রশংসা করে। তবে যোষেফ চেয়েছিলেন, যেন সমস্ত কৃতিত্ব তার ঈশ্বর, যিহোবাই লাভ করেন। আমাদের যে-দক্ষতাই থাকুক না কেন, আমরা যদি তা আমাদের ঈশ্বরের সেবায় কাজে লাগাই, তা হলে তিনি হয়তো সেই দক্ষতা এমনভাবে ব্যবহার করতে সাহায্য করবেন, যা আমরা কল্পনাও করিনি।

কিন্তু, পরে গিয়ে মিশরীয়রাও দুর্ভিক্ষের প্রভাব বুঝতে পারে। তারা যখন সাহায্যের জন্য ফরৌণের কাছে ক্রন্দন করে, তখন তিনি তাদের নির্দেশ দেন: “তোমরা যোষেফের নিকটে যাও; তিনি তোমাদিগকে যাহা বলেন, তাহাই কর।” এর ফলে, যোষেফ শস্যের গোলা ঘর খুলে দেন, যাতে লোকেরা সেখান থেকে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী শস্য কিনতে পারে।—আদিপুস্তক ৪১:৫৫, ৫৬.

কিন্তু, আশেপাশের দেশগুলোতে লোকেদের অবস্থা মিশরীয়দের মতো ছিল না। শত শত কিলোমিটার দূরে কনান দেশে যোষেফের পরিবারও এই কষ্টভোগ করছিল। বৃদ্ধ যাকোব শুনতে পান যে, মিশরে শস্য রয়েছে, তাই তিনি তার ছেলেদের বলেন, যেন তারা সেখান থেকে খাদ্য কিনে নিয়ে আসে।—আদিপুস্তক ৪২:১, ২.

যাকোব তার সমস্ত ছেলেকে পাঠান, তবে সবচেয়ে ছোটো ছেলে বিন্যামীনকে নয়। সেই সময়ের কথা যাকোবের স্পষ্ট মনে আছে, যখন তিনি তার প্রিয় ছেলে যোষেফকে একা তার ভাইদের খবর আনতে পাঠিয়েছিলেন। এর পরে তিনি আর কখনো তার ছেলেকে দেখতে পাননি। যাকোবের অন্য ছেলেরা যোষেফের ছেঁড়া এবং রক্তমাখা জামা নিয়ে এসেছিলেন, যে-সুন্দর জামাটা তিনি অনেক আদর করে যোষেফকে বানিয়ে দিয়েছিলেন। এটা দেখে যাকোব একেবারেই ভেঙে পড়েছিলেন আর তার ছেলেরা তাদের বৃদ্ধ বাবাকে এটা বিশ্বাস করতে পরিচালিত করেছিলেন যে, যোষেফকে সত্যিই কোনো বন্যপশু খেয়ে ফেলেছে।—আদিপুস্তক ৩৭:৩১-৩৫.

‘যোষেফের স্মরণ হইল’

অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়ার পর, যাকোবের ছেলেরা মিশরে আসেন। তারা যখন শস্য ক্রয় করার কথা জিজ্ঞেস করেন, তখন তাদেরকে সাফনৎ-পানেহ নামে একজন উচ্চ সরকারি কর্মকর্তার কাছে যেতে বলা হয়। (আদিপুস্তক ৪১:৪৫) তারা যখন সেই কর্মকর্তাকে দেখতে পান, তখন তারা কি চিনতে পেরেছিলেন যে, তিনিই হচ্ছেন যোষেফ? না। তারা তাকে একজন উচ্চপদস্থ মিশরীয় শাসক হিসেবে দেখেছিলেন, যার সাহায্য তাদের প্রয়োজন। সম্মান দেখানোর জন্য স্বাভাবিকভাবেই তারা “তাঁহার কাছে গিয়া ভূমিতে মুখ দিয়া প্রণিপাত করিলেন।”—আদিপুস্তক ৪২:৫, ৬.

যোষেফ সম্বন্ধে কী বলা যায়? তিনি সঙ্গেসঙ্গে তার ভাইদের চিনতে পারেন! সবচেয়ে বড়ো কথা হল, তিনি যখন তাদেরকে তার সামনে প্রণিপাত করতে দেখেন, তখন তার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যায়। বিবরণ আমাদের জানায়, ছোটোবেলায় যিহোবার কাছ থেকে “যোষেফ . . . যে যে স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন, তাহা তাঁহার স্মরণ হইল।” এই স্বপ্নগুলোর মাধ্যমে বোঝানো হয়েছিল, এমন একটা সময় আসবে, যখন ভাইয়েরা তার সামনে প্রণিপাত করবে আর এখন তারা ঠিক এই কাজটাই করছেন! (আদিপুস্তক ৩৭:২, ৫-৯; ৪২:৭, ৯) যোষেফ কী করবেন? তাদের জড়িয়ে ধরবেন? নাকি প্রতিশোধ নেবেন?

যোষেফ বুঝতে পারেন, আবেগের বশে তার কোনোটাই করা উচিত নয়। স্পষ্টতই, এই উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর পিছনে যিহোবারই হাত ছিল। এগুলোর সঙ্গে তাঁর উদ্দেশ্য জড়িত ছিল। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যাকোবের বংশ এক বলবান জাতি হয়ে উঠবে। (আদিপুস্তক ৩৫:১১, ১২) যোষেফের ভাইয়েরা যদি এখনও হিংস্র, স্বার্থপর এবং খারাপ থাকে, তা হলে ভবিষ্যতে এর প্রভাব খারাপ হতে পারে অর্থাৎ সেই প্রতিজ্ঞা পরিপূর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা আসতে পারে! এ ছাড়া, যোষেফ যদি আবেগের বশে কাজ করেন, তা হলে তিনি হয়তো পরিবারের পরিস্থিতিকে, এমনকী তার বাবা ও বিন্যামীনের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারেন। তারা কি এখনও বেঁচে আছেন? যোষেফ তার পরিচয় গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নেন, যাতে তিনি তার ভাইদের পরীক্ষা করে দেখতে পারেন যে, এখনও তারা আগের মতো আছেন কি না। তাহলে তিনি বুঝতে পারবেন, যিহোবা তার কাছ থেকে কী চান।

আপনি হয়তো কখনো এইরকম অস্বাভাবিক ঘটনার মুখোমুখি হননি। কিন্তু, বর্তমান জগতে পরিবারের মধ্যে শত্রুতা এবং ভাঙন খুবই সাধারণ বিষয়। আমরা যখন এইরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হই, তখন আমরা সাধারণত আবেগের বশবর্তী হয়ে আমাদের ইচ্ছে অনুযায়ী কাজ করি। সেই সময় যোষেফকে অনুকরণ করা এবং সেই পরিস্থিতিতে আমরা কী করি বলে ঈশ্বর চান, তা বোঝার চেষ্টা করা আরও বেশি বিজ্ঞতার কাজ। (হিতোপদেশ ১৪:১২) মনে রাখবেন, যদিও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শান্তি বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু যিহোবা ও তাঁর পুত্রের সঙ্গে শান্তি বজায় রাখা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।—মথি ১০:৩৭.

“তোমাদের পরীক্ষা করা যাইবে”

যোষেফ পর পর কয়েকটা পরীক্ষা করেন, যাতে তিনি তার ভাইদের হৃদয়ের অবস্থা জানতে পারেন। প্রথমে, তিনি একজন অনুবাদকের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে কর্কশভাবে কথা বলেন, তাদেরকে বিদেশি চর বলে দোষারোপ করেন। নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য তারা বলেন, তাদের একটা পরিবার রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, তারা এও জানান যে, তাদের সবচেয়ে ছোটো ভাই বাড়িতে রয়েছেন, যেটা জানার জন্য যোষেফ উৎসুক ছিলেন। যোষেফ তার উত্তেজনা চেপে রাখার চেষ্টা করেন। তার ছোটো ভাই কি সত্যিই বেঁচে আছেন? এখন তিনি বুঝতে পারেন, তার কী করা উচিত। তিনি বলেন: “ইহা দ্বারা তোমাদের পরীক্ষা করা যাইবে” আর এরপর প্রমাণ হিসেবে তিনি তাদের ছোটো ভাইকে নিয়ে আসতে বলেন। পরে, তিনি এই শর্তে অন্যদের বাড়ি ফিরে গিয়ে সবচেয়ে ছোটো ভাইকে নিয়ে আসার অনুমতি দেন যে, একজনকে তার এখানে জামিন হিসেবে থাকতে হবে।—আদিপুস্তক ৪২:৯-২০.

তার ভাইয়েরা যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করেন, তখন তারা ২০ বছর আগে করা তাদের ভয়ানক পাপের জন্য নিজেদের দোষারোপ করতে থাকেন। তবে, যোষেফ যে তাদের কথা বুঝতে পারছেন, তা তারা জানতেন না। তারা বলেন, “নিশ্চয়ই আমরা আপনাদের ভাইয়ের বিষয়ে অপরাধী, কেননা সে আমাদের কাছে বিনতি করিলে আমরা তাহার প্রাণের কষ্ট দেখিয়াও তাহা শুনি নাই; এই জন্য আমাদের উপরে এই সঙ্কট উপস্থিত হইয়াছে।” যোষেফ তাদের কথা বুঝতে পারছিলেন আর তিনি সেখান থেকে সরে যেতে বাধ্য হন, যাতে ভাইয়েরা তার কান্না দেখতে না পান। (আদিপুস্তক ৪২:২১-২৪) কিন্তু তিনি জানেন, মন্দ কাজের পরিণতি নিয়ে কেবল অনুশোচনা করাই যথেষ্ট নয়, প্রকৃত অনুতাপের সঙ্গে আরও বেশি কিছু জড়িত। তাই, তিনি তার পরীক্ষা চালিয়ে যান।

তিনি তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেন এবং শিমিয়োনকে বন্দি করে রাখেন। এ ছাড়া, তিনি তাদের শস্যের ছালার মুখে টাকা লুকিয়ে রাখার আদেশ দেন। ভাইয়েরা বাড়ি ফিরে যান এবং অনেক কষ্টে যাকোবকে রাজি করিয়ে তার প্রিয় ছেলে বিন্যামীনকে তাদের সঙ্গে মিশরে নিয়ে যান। তারা যখন মিশরে ফিরে আসেন, তখন তারা সরাসরি যোষেফের গৃহাধ্যক্ষকে ছালার মুখে টাকা পাওয়ার কথা জানান এবং পুরো টাকা ফেরত দিতে চান। এটা সত্যিই প্রশংসনীয়, তবে তারা সত্যিই পরিবর্তন হয়েছেন কি না, তা বোঝার জন্য যোষেফের আরও সময়ের প্রয়োজন। বিন্যামীনকে দেখে আনন্দ লুকাতে না পেরে যোষেফ তাদের জন্য বিরাট ভোজের ব্যবস্থা করেন। এরপর, তিনি আবারও প্রচুর শস্য দিয়ে তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেন, তবে এই বার বিন্যামীনের ছালার মুখে রুপোর বাটি লুকিয়ে রাখা হয়।—আদিপুস্তক ৪২:২৬–৪৪:২.

এরপর তিনি যে-ফাঁদ পেতে রাখেন, সেটার জাল গোটাতে শুরু করেন। তিনি তার ভাইদের ধাওয়া করার জন্য লোক পাঠান। তারা তাদেরকে বন্দি করেন এবং রুপোর বাটি চুরি করার জন্য দোষারোপ করেন। বিন্যামীনের ছালার মুখে যখন সেই বাটি পাওয়া যায়, তখন তাদের সবাইকে যোষেফের কাছে নিয়ে আসা হয়। এখন যোষেফ জানতে পারবেন যে, তার ভাইয়েরা আসলে কী ধরনের ব্যক্তি। যিহূদা তাদের হয়ে কথা বলেন। তিনি ক্ষমা ভিক্ষা চান, এমনকী তারা ১১ জন ভাই-ই মিশরে দাস হবেন বলে কথা দেন। কিন্তু উত্তরে যোষেফ বলেন, কেবল বিন্যামীনই মিশরে দাস হিসেবে থাকবেন আর বাকি সবাই বাড়ি ফিরে যাবেন।—আদিপুস্তক ৪৪:২-১৭.

যিহূদা তখন কাতর হয়ে অনুরোধ জানান। যিহূদা বলেন, “সেইমাত্র তাহার মাতার অবশিষ্ট পুত্ত্র; এবং তাহার পিতা তাহাকে স্নেহ করেন।” সেই কথাগুলো নিশ্চয়ই যোষেফের হৃদয় স্পর্শ করেছিল, কারণ যোষেফ ছিলেন যাকোবের প্রিয় স্ত্রী রাহেলের বড়ো সন্তান, যিনি বিন্যামীনকে জন্ম দেওয়ার সময় মারা গিয়েছেন। স্পষ্টতই, তার বাবার মতো যোষেফেরও তার মায়ের কথা এখনও মনে আছে। সম্ভবত এই কারণেই বিন্যামীন যোষেফের খুব আদরের ভাই ছিলেন।—আদিপুস্তক ৩৫:১৮-২০; ৪৪:২০.

যিহূদা মরিয়া হয়ে যোষেফকে অনুরোধ করে চলেন, যাতে তিনি বিন্যামীনকে দাস হিসেবে আটকে না রাখেন। এমনকী বিন্যামীনের পরিবর্তে তিনি নিজে দাস হতে চান। অবশেষে তিনি এভাবে তার করুণ পরিস্থিতির কথা ব্যাখ্যা করেন: “এই যুবকটী আমার সহিত না থাকিলে আমি কি প্রকারে পিতার নিকটে যাইতে পারি? পাছে পিতার যে আপদ ঘটিবে, তাহাই আমাকে দেখিতে হয়।” (আদিপুস্তক ৪৪:১৮-৩৪) এখন যোষেফ বুঝতে পারেন যে, যিহূদা সত্যিই পরিবর্তিত হয়েছেন। তিনি কেবল অনুতাপই দেখাননি কিন্তু সেইসঙ্গে সহানুভূতি, নিঃস্বার্থপর মনোভাব এবং সমবেদনাও দেখান, যা সত্যিই প্রশংসাযোগ্য।

যোষেফ বুঝতে পেরেছিলেন যে, তার ভাইয়েরা তার প্রতি যা করেছিলেন, সেটার জন্য তারা অনুশোচনা করছে

যোষেফ আর তার আবেগ আটকে রাখতে পারছিলেন না। এখন তিনি তা প্রকাশ করতে বাধ্য হন। তার সমস্ত দাসকে বের করে দিয়ে তিনি এত জোরে কাঁদতে শুরু করেন যে, সেই শব্দ ফরৌণের প্রাসাদ থেকেও শোনা যায়। অবশেষে, তিনি ভাইদের কাছে নিজের পরিচয় দেন: “আমি যোষেফ, তোমাদের ভাই।” এই কথা শুনে তার ভাইয়েরা হতবাক হয়ে যান, কিন্তু যোষেফ তাদের জড়িয়ে ধরেন এবং তার প্রতি করা তাদের অপরাধ সদয়ভাবে ক্ষমা করে দেন। (আদিপুস্তক ৪৫:১-১৫) এভাবে তিনি যিহোবার মতো মনোভাব দেখান, যিনি উদারভাবে ক্ষমা করেন। (গীতসংহিতা ৮৬:৫) আমরাও কি তা করি?

“তুমি এখনও জীবিত আছ”!

যোষেফের বাড়ি থেকে কান্নাকাটির শব্দ শোনার পর, ফরৌণ যখন পুরো কাহিনি জানতে পারেন, তখন তিনি যোষেফকে বলেন যে, চাইলে যোষেফ তার বৃদ্ধ বাবা ও সেইসঙ্গে পুরো পরিবারকে মিশরে নিয়ে আসতে পারেন। অল্প দিনের মধ্যেই যোষেফ অবশেষে তার প্রিয় বাবাকে আবার দেখতে পান। যাকোব কাঁদতে থাকেন এবং এই কথা বলেন: “এখন স্বচ্ছন্দে মরিব, কেননা তোমার মুখ দেখিতে পাইলাম, তুমি এখনও জীবিত আছ।”—আদিপুস্তক ৪৫:১৬-২৮; ৪৬:২৯, ৩০.

যাকোব আরও ১৭ বছর মিশরে বেঁচে থাকেন। তিনি তার ১২ জন ছেলেকে ভবিষ্যদ্‌বাণীরূপে বিভিন্ন আশীর্বাদ দেওয়ারও সুযোগ পান। তিনি যোষেফকে দুই অংশ দান করেন, যা সাধারণত প্রথমজাত অর্থাৎ সবচেয়ে বড়ো সন্তানের পাওয়ার কথা আর যোষেফ ছিলেন তাদের মধ্যে একাদশতম। ইস্রায়েলের দুই বংশ যোষেফের কাছ থেকে আসবে। আর চতুর্থ ছেলে যিহূদা সম্বন্ধে কী বলা যায়, যিনি ভাইদের চেয়ে আরও বেশি অনুতপ্ত মনোভাব দেখিয়েছিলেন? তিনি এই বড়ো আশীর্বাদ লাভ করেন: মশীহ অর্থাৎ খ্রিস্ট তার বংশ থেকেই আসবে!—আদিপুস্তক ৪৮, ৪৯ অধ্যায়।

যাকোব যখন ১৪৭ বছর বয়সে মারা যান, তখন যোষেফের ভাইয়েরা এই ভেবে ভয় পান যে, তাদের ক্ষমতাবান ভাই হয়তো এবার প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করবেন। কিন্তু, যোষেফ তাদেরকে প্রেমের সঙ্গে আশ্বাস দেন যে, তিনি এইরকম কিছু করবেন না। তিনি দৃঢ়ভাবে তাদের বলেন, মিশরে তাদের পরিবার আসার পিছনে যিহোবারই হাত রয়েছে, তাই যা ঘটেছে, তা নিয়ে তারা যেন অযথা আর খারাপ বোধ না করেন। এরপর তিনি এই চমৎকার প্রশ্নটা করেন: “আমি কি ঈশ্বরের প্রতিনিধি?” (আদিপুস্তক ১৫:১৩; ৪৫:৭, ৮; ৫০:১৫-২১) যোষেফ বুঝতে পারেন, যিহোবা হচ্ছেন একেবারে ন্যায্য বিচারক। তাই, যিহোবা যাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন, তাদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা যোষেফের কীভাবে থাকতে পারে?—ইব্রীয় ১০:৩০.

কখনো কখনো আপনিও কি ক্ষমা করাকে কঠিন বলে মনে করেন? বিশেষভাবে এটা সেই সময় কঠিন বলে মনে হতে পারে, যখন কেউ জেনে-শুনে আমাদের ক্ষতি করে। কিন্তু, যারা প্রকৃত অনুতাপ প্রকাশ করে, তাদেরকে যদি আমরা হৃদয় থেকে ক্ষমা করে দিই, তা হলে আমরা অনেক ক্ষত সারিয়ে তুলতে পারি, এমনকী আমাদের নিজেদেরগুলোও। আর এভাবে আমরা যোষেফের বিশ্বাস এবং তার করুণাময় পিতা যিহোবার উদাহরণ অনুকরণ করতে পারব। ▪ (w১৫-E ০৫/০১)